সর্বক্ষেত্রেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সফলতা অর্জন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল । ব্যক্তিক সিদ্ধান্তে যদি ভুল হয় তাহলে ব্যক্তি ও তার পরিবার এর কুফল ভোগ করে । প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ যদি ভুল করেন তবে প্রতিষ্ঠানকে এ ভুলের মাশুল দিতে হয় । একজন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় লাভজনক ব্যবসায়ের সন্ধান পেয়ে লেখাপড়া শেষ না করেই তাতে ঢুকে পড়লো । এক পর্যায়ে ব্যবসায় বন্ধ । অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিটাও নেয়া হলো না । জীবনটাই মাটি হওয়ার পালা । একটা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিগণ কাজ বাড়বে চিন্তা করে বেশি লোক নিয়োগ দিলেন । কাজ বাড়লো না কিন্তু বেশি লোক নিয়োগের কারণে ব্যয়সহ নানান জটিলতা প্রতিনিয়তই ভোগ করতে হচ্ছে । সমস্যা নিরসনের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে নতুন নতুন সমস্যা মোকাবেলার নজীর প্রায়শই লক্ষণীয় । শ্রমিকদের দু'টি দল গন্ডগোল করেছে । কর্তৃপক্ষ দু'দলের দু'জনকে চাকরি থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিলেন । পরে দেখা গেল সব শ্রমিক একত্রিত হয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে । তাই নানান বিষয় সতর্কতার সাথে বিবেচনা করেই প্রতিষ্ঠান সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় । এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়সমূহ নিম্নরূপ:
১. সমস্যার প্রকৃতি (Nature of problem): যে সমস্যা সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তা সমস্যা হিসেবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সমস্যার প্রকৃতি ও গভীরতা কেমন ইত্যাদি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হয় । অনেক সময় প্রতিষ্ঠান ছোট বিষয়কে বড় করে দেখে সিদ্ধান্ত নেয় । কিন্তু পরে দেখা যায়, নতুন সিদ্ধান্ত না নিয়ে অন্যভাবে ম্যানেজ করা যেতো । অনেক সিদ্ধান্ত থাকে যেগুলো পৌনঃপুনিক প্রকৃতির; যেমন- কাঁচামাল ক্রয়, মজুত পণ্য বিক্রয়, কর্মী নিয়োগ ইত্যাদি । যেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ । কিন্তু কিছু সিদ্ধান্ত থাকে যেগুলির প্রভাব ও ফলাফল ব্যাপক হয়ে থাকে; যেমন- শ্রমিক অসন্তোষ, কারখানা পুড়ে যাওয়া, অন্য কোম্পানির সাথে একত্রীভূত হওয়া ইত্যাদি। এরূপ ক্ষেত্রে অনেক ভেবে-চিন্তে সমস্যা মোকাবেলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন। পড়ে ।
২. ভবিষ্যৎ অবস্থা (Future condition): সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে ভবিষ্যৎ অবস্থা কী দাঁড়াবে তাও বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হয় । কাঁচামালের দাম কমেছে বিবেচনায় একটা প্রতিষ্ঠান বেশি কাঁচামাল কিনে তা মজুদ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে । কিন্তু যদি দেখা যায়, বাজারে পণ্যের চাহিদা এ সময়ে কম থাকবে বিধায় বেশি পরিমাণে কাঁচামাল কিনলে তা অব্যবহৃত অবস্থায় গুদামে পড়ে থাকবে । এতে পুঁজি আটকে থাকার এবং কাঁচামাল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকির সৃষ্টি হবে। তা হলে কর্তৃপক্ষ এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে বিরত থাকবে । ভবিষ্যৎ অবস্থা নিশ্চিত হলে একভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কিন্তু যদি এরূপ অবস্থা ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার নির্দেশ করে তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে ।
৩. প্রাপ্ত তথ্য (Received information) : সকল ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমবেশি তথ্য বিবেচনার প্রয়োজন পড়ে । ধারণা বা অনুমানের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিলে অনেক সময়ই তা ক্ষতির কারণ হয় । একজন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে কাঁচামাল সরবরাহ করেন। বাজার সম্পর্কে পর্যাপ্ত খোঁজ-খবর না নিয়ে তাকেই মাল সরবরাহের ফরমায়েশ দেয়া হচ্ছে। বাজারে কাঁচামালের মূল্য কমলেও সঠিক তথ্য প্রতিষ্ঠানের নিকট থাকায় পুরনো দামে মাল কেনার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর । তথ্য পেলেও সেই তথ্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটাও দেখা দরকার । সবমিলিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীগণের নিকট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় সকল বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকার ও তার বিবেচনার প্রয়োজন পড়ে ।
৪. সিদ্ধান্ত লক্ষ্য (Decision goal): অনেক সময় বিশেষ লক্ষ্য সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের লক্ষ্যকে যথার্থরূপে বুঝে নিয়ে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এগুনোর প্রয়োজন পড়ে । ধরা যাক, শ্রমিক-কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেল দেয়া হবে । এরূপ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্য হতে পারে প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্যের মধ্যে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হবে এবং জনশক্তিও তাতে সন্তুষ্ট থাকবে । এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে শ্রমিক- কর্মচারীদের সাথে ঊর্ধ্বতন মত বিনিময় করতে পারেন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ কমিটিতে কর্মচারীদের প্রতিনিধি রাখতে পারেন । এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য থাকে যেভাবেই হোক নতুন বেতন কাঠামো যেনো সবার নিকট গ্রহণযোগ্য হয়। শ্রমিক-কর্মীদের অভিযোগ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিতে যেন তা নতুন অভিযোগের সৃষ্টি না করে সে বিষয়টিও মনে রাখা আবশ্যক ।
৫. সহযোগিতার মাত্রা (Degree of co-operation): সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী পক্ষসমূহের সহযোগিতা কেমন পাওয়া যাবে সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা আবশ্যক । প্রতিষ্ঠানে অধস্তনরা যোগ্য ও আন্তরিক হলে উর্ধ্বতন যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক ভালো না হলে বা অধস্তনরা যোগ্য না হলে তাদের নিকট থেকে যথোপযুক্ত সহযোগিতা পাওয়া যায় না। প্রতিষ্ঠানে অংশীদারিত্বমূলক ব্যবস্থাপনা, শিল্পীয় গণতন্ত্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা গেলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে এরূপ সহযোগিতার মাত্রা বেশি হয় ।
৬. প্রাপ্তব্য সময় (Receivable time): সিদ্ধান্তের সাথে সময়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান । ভালো সিদ্ধান্ত নিলেই চলে না- যথাসময়ে ঐ সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন । সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে একটা সময়ের পার্থক্য থাকে । যদি এমন সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, তা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি গ্রহণে প্রয়োজনীয় সময় পাওয়া যাচ্ছে না তাহলে ঐ সিদ্ধান্ত উত্তম সিদ্ধান্ত নয় । সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তথ্য সংগ্রহ, আলোচনা, পরামর্শ ইত্যাদি কাজে সময়ের দরকার হয় । মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সেখানেও সময়ের প্রয়োজন। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্যোগও যথাসময়ে নেয়া আবশ্যক ।
বর্তমানকালে বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সো'ট (SWOT) বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেয় । SWOT বিশ্লেষণ বলতে শক্তি (Strength), দুর্বলতা (Weakness), সুযোগ (Opportunity) ও ভীতি (Threat)- এ চারটা ও উপাদান বা বিষয়কে পাশাপাশি রেখে বিশ্লেষণ করাকে বুঝায়। যার প্রথম দু'টি অভ্যন্তরীণ উপাদান এবং পরের দু'টি বাহ্যিক উপাদান বিবেচনা করা হয়ে থাকে। শক্তি (Strength) এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সামর্থ্য, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, জনশক্তির উচ্চ মান ইত্যাদি বিষয় পড়ে । দুর্বলতা (Weakness ) এর মধ্যে মূলধনের অভাব, ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, সুনামের অভাব ইত্যাদিকে বুঝায়। অন্যদিকে সুযোগ (Opportunity) বলতে বাজার সম্ভাবনা, প্রতিযোগীদের দুর্বল অবস্থা, অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ ইত্যাদি বুঝানো হয় । ভীতি (Treat) এর মধ্যে ক্ষতিকর প্রতিযোগী পরিবেশ, অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা, শক্তি-সম্পদের অভাব ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ।
আরও দেখুন...